ঘূর্ণিঝড় রিমাল'র ঝড়ো বাতাসে বড় গাছ ভেঙে না পড়ে উপড়ে পড়ছে। উপড়ে গাছ গুলোর মধ্যে বেশিরভাগই চাম্বল। এছাড়াও রেইন্ট্রি, মেহগনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছই উপড়ে পড়ছে বেশি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছের এক বছর বয়সী ছোট চারার চেয়ে দুই বছর বা তিন বছর বয়সী গাছের চারা লাগাতে আগ্রহী বেশিরভাগ মানুষ। নার্সারী থেকে টালি বা পলিব্যাগে বপণকৃত বীজের অংকুরোদগমের সময় মূল শিকড় স্বাধীনভাবে বাড়তে পারে না। টালি বা পলিব্যাগের মধ্যেই মুড়িয়ে থাকে। অনেক সময় পলিব্যাগ ছিড়ে বের হলেও নার্সারী মালিক উত্তোলনের সুবিধার্থে তা কেটে রাখে। বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হয়ে বেড়ে ওঠার সময় মূল শিকড় না থাকায় রোপনের পরে ওই চারার মূল শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া অনেক সময় সামান্য গর্ত করেই চারা রোপন করা হয়। যার ফলে নীচের মাটি শক্ত থাকায় ছোট চারা রোপণ করলেও মূল শিকড় শক্ত মাটি ভেদ করতে পারে না। তাই শিকড় সামান্য মাটির নীচেই মুড়িয়ে থাকে। ঝালকাঠি বনবিভাগের সাথে কথা বলেই এসব তথ্য জানাগেছে। গ্রাম অথবা শহর সবখানেই অপরিকল্পিতভাবে চারা রোপনের ফলেই ঝড়ে গাছ ভাঙার চেয়ে উপড়ে পড়ছে বেশি। তাছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে ফুটপাত ঘেঁষে লাগানো গাছগুলো সবচেয়ে বেশি উপড়ে পড়েছে। পৌর এলাকার গাছ উপড়ে পড়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে সংখ্যা না জানতে পারলেও আনুমানিক দেড় থেকে দুইশ গাছ ভেঙে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ২৭মে ঘুর্ণিঝড় রিমাল'র সাথে অতিরিক্ত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গাছের গোড়ার মাটি একদমই নরম হয়ে যায়। মূল শিকড় গভীরে না থাকায় বাতাসের ধাক্কায় গাছ উপড়ে পড়ে। প্রবল ঝড়ের পাশাপাশি অল্প ঝড়েও রাস্তায় গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায়। কখনও কখনও ঘটে ছোট-বড় দুর্ঘটনাও। প্রশ্ন উঠেছে, খোলা মাঠের চেয়ে নদী খাল, পুকুর, দিঘী, জলাশয় ও সড়কের আশপাশে লাগানো গাছই কেন বেশি পড়ছে?
উদ্ভিদ বিশেজ্ঞরা বলছেন, এত বড় ঝড়ে কিছু গাছ পড়বে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সোমবার (২৭মে) এত গাছ পড়া স্বাভাবিকভাবে নেয়া যায় না। এ ছাড়া সাধারণ ঝড়েও হারহামেশা গাছ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। মূলত রাস্তার পাশে, নদী, খাল, পুকুর, জলাশয়, দিঘী বা ফুটপাতে লাগানো গাছ শক্ত কোনো ভিতের ওপর না থাকা এবং নার্সারি থেকে প্রধান মূল কাটা গাছ সংগ্রহ করে রোপণ করার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে পৌর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী নাজমুল হাসান বলেন, বর্তমান বাস্তবতাকে সামনে রেখে আগামীতে সড়ক ও ফুটপাত তৈরির সময় সেখানে লাগানো গাছ যাতে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সেটা মাথায় রেখেই কাজ করা হবে।
ওই প্রকৌশলী জানান, রিমাল নামক ঘূর্ণিঝড়ে শহর ও গ্রামের বিভিন্ন সড়কের ওপর গাছ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ঝড়ের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি টিম সেই সব গাছ অপসারণ করেছে। এখন সব সড়কই চলাচলে উপযোগী হয়েছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবনের সামনে থাকা আরও কিছু গাছ পড়েছে।
শহরের বাঁশপট্টি এলাকার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পাশের গলিতেই আমি থাকি। ২৭মে সোমবার দুপুরে ঝড়ের সময় জোরে একটা শব্দ শুনতে পাই। বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা নিয়ে বের হয়ে দেখি বাতাশে একটি গাছ পড়ে গেছে। ভাগ্য ভালো, তখন এখানে কোনো মানুষ ছিল না, থাকলে বড় কোন দুর্ঘটনা হয়ে যেত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এইখানে একটু জোরে ঝড় হলেই গাছ পড়ে যায়। মূলত এইখানের মাটি ভালো না। তাছাড়া গাছের এক পাশেই রয়েছে ইটের প্রাচীর আর এক পাশে রয়েছে রাস্তা। এর মাঝে তো গাছের শিকড় বেশি দূরে যেতে পারে না। যার কারণে এখানে একটু জোরে বাতাস হলেই মাঝে মাঝে গাছ পড়ে যায়।’
রাস্তার মাঝে ও পাশের লাগানো গাছ কেন বেশি উপড়ে যায় এমন প্রশ্নের জবাবে ঝালকাঠি বন কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গাছ পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে আমরা দেখতে পাই আমাদের শহরের বেশিরভাগ রাস্তার পাশের জায়গা প্রশস্ত নয় এবং এর গভীরতাও বেশি নয়। দেখা যায়, গাছের চারা রোপনের সময় নিচের কনক্রিট বা ইট জাতীয় বস্তু রেখেই তা তৈরি হয়। এ কারণে গাছের শেকড় বেশি বিস্তৃতি লাভ করতে পারে না।
‘এ ছাড়া ফুটপাত ও আইল্যান্ড ভালো মাটি দিয়েও ভারাট করে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার কারণে আমরা দেখতে পাই একটু ঝোড়ো হাওয়া হলেই শহরের কোথাও না কোথাও রাস্তায় গাছ পড়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সড়কের পাশে পর্যাপ্ত জায়গাও নেই। তারপরও কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এই বিষয়গুলো নজরে রেখে পরিকল্পনা করে গাছ লাগানো।’
বন কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সাধারণত ৫ থেকে ৬ ফুট উচ্চতার গাছ রোপণ করে, যাতে গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলতে না পারে। এই গাছগুলো যেহেতু ২ থেকে ৩ বছর নার্সারিতে থাকতে হয়, তাই এই গাছগুলোর মূল মাটির গভীরে চলে যায়। যখন নার্সারির মালিক এই গাছগুলো টবে বা পলিব্যাগে উঠিয়ে বিক্রি করেন, তখন মাটির গভীরে থাকা গাছের প্রধান শেকড় কেটে ছোট করে তুলে আনেন। এতে হয়তো গাছ বাঁচে, কিন্তু প্রধান শেকড় না থাকায় এই গাছগুলোর মূল এবং শিকড় বেশি দূর যেতে পারে না। স্বভাবিকভাবেই এই গাছ একটু জোরে ঝোড়ো হাওয়া হলেই উপড়ে পড়ছে। গাছ উপড়ে পড়ার এটা একটা বড় কারণ।
মতামত